আবদুর রহমান, টেকনাফ::
কোনোভাবে একবার থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় যেতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান। মাসে লাখ টাকা উপার্জন করার যাবে–এমন মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে সাগর পথে বিদেশে পাড়ি জামাতে গিয়ে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন লোকজন। আর এই মানবপাচারকারীদের মূল্য লক্ষ্য এখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতারা বলেছেন, উন্নত জীবনের আশা এবং বিয়ে প্রলোভনে তরুণীরা সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো ঝুঁকি নিচ্ছেন। দালালরা রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ফাঁদে ফেলছে। সংশ্লিস্টদের মতে, মানবপাচার রোধ করা না গেলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভারমূতি ক্ষুণ্ন হবে।
কক্সবাজার থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে যাওয়ার পথে ১১ ফেব্রুয়ারি ও ১৫ এপ্রিল ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৪৭৬ জনকে। এছাড়া গত কয়েকদিন ধরে রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে এমন খবরে সীমান্ত ও উপকূলে টহল জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্ট গার্ড ও পুলিশ সদস্যরা। পাশপাশি তাদের ঠেকাতে পাহারা বসিয়েছে জেলে ও স্থানীয় লোকজন।
বুধবার (২২ এপ্রিল) এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়া থেকে বের করে দেওয়া আনুমানিক পাঁচশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উদ্ধার করে আশ্রয় দিতে বলেছে বাংলাদেশকে। মানবাধিকার এই সংস্থাটি বলেছে, ধারণা করা হচ্ছে গভীর সমুদ্রে আরও একটি জাহাজ থাকতে পারে। যেখানে আরও কয়েকশ রোহিঙ্গা আটকা পড়েছেন।
এ বিষয়ে টেকনাফ বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সাল হাসান খান বলেন, ‘সীমান্ত ও উপকূল দিয়ে যাতে নতুন করে কোনও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য টহল জোরদার করা হয়েছে। পাশপাশি স্থানীয়দের সর্তক থাকতে বলা হয়েছে। যাতে রোহিঙ্গা বোঝাই কোনও ট্রলার ঢুকতে না পারে।
পুলিশ ও কোস্টগার্ড জানায়, ১৫ এপ্রিল টেকনাফে বাহারছড়ায় মালয়েশিয়া যাত্রা ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসা আরও ৩৯৬ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। এসব যাত্রীরা জানিয়েছে, ট্রলারে মারা গেছেন ৩০ জন। এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৩৮ জন রোহিঙ্গা নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সেন্টমার্টিনের পশ্চিমে একটি ট্রলার ডুবে যায়। ওই ঘটনায় ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। আর ১৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নিখোঁজ হন।
এ ব্যাপারে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের (ইনচার্জ) পরিদর্শক মোহাম্মদ লিয়াকত আলী বলেন, ‘সচেতনতার অভাবে রোহিঙ্গারা সাগর পাড়ি দিচ্ছেন। ফলে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যে কোনোভাবে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও পাচার ঠেকানো হবে। আর যেসব পাচারকারী এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে তাদের ধরতে অভিযান চলছে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি জানিয়েছে, ভাগ্যান্বেষণে দেশান্তরিত হতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন বহু শরণার্থী। যাদের অধিকাংশ সাগর পথে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। ২০১২-১৫ এই তিন বছরের সোয়া লাখ মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে। এর বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। সেসময় মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ডের একটি জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান মেলে। এরপর মাঝখানে দুই বছর মানবপাচার কমে যায়। এরপর ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। এরপর ফের মানবপাচার শুরু হয়। ২০১৮-২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে ১৬০০ রোহিঙ্গা পাচার হয়। এই সময় ১৫ জন মারা গেছেন। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২০ মার্চ পর্যন্ত মোট ১৫ হাজার রোহিঙ্গা পাচার হয়েছে। যার মধ্যে বড় অংশ ছিল নারী ও শিশু। এছাড়া ২০১৭ আগস্ট থেকে ২০১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৮টি নৌকা ডুবির ঘটনায় ১৯৭ জনের লাশ উদ্ধার এবং অন্তত নিখোঁজ হন ৫০০ জন।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান জানান, ‘একটা সময় শুধু রোহিঙ্গা পুরুষরা কাজের তাগিদে সাগর পাড়ি দিতেন। এখন কিন্তু নারী ও শিশু পাচারও বাড়ছে। এ ঘটনায় মানবপাচার বিষয়ক মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ট্রাফিকিং ইন পারসন (টিআইপি) প্রতিবেদনে তিন বছর ধরে বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ তালিকায় আছে। সেখানে কিন্তু বারবার রোহিঙ্গা পাচারের বিষয়টি উঠে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এক কথাই যদি বলি, মানবপাচার বন্ধ না হলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ যে মানবতার পরিচিতি পেয়েছে সেই ভার্বমূতি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কাজেই কোস্ট গার্ড, পুলিশ ও বিজিবিসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও নজরদারি বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনে সীমান্তের সক্ষমতা বাড়িয়ে, পাচার বন্ধ করতে হবে।’
কক্সবাজারের আইওএমের ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার তারেক মাহমুদ বলেন, ২০১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ মার্চ পর্যন্ত পাচারের শিকার ৬৫৪ জনকে সহতায় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৯৫ রোহিঙ্গা। বাকি ৩৫৯ স্থানীয় জনগোষ্ঠী। পাচার রোধে ক্যাম্পসহ সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় ২০১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ মার্চ পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৯৯টি সচেতনতা মূলক আলোচনার মাধ্যামে ১ লাখ ৫৩ হাজার মানুষকে পাচার রোধে সচেতন করা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি আশ্রয়প্রার্থী বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে। যা ২০১৩-১৫ সালে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া মানুষের তুলনায় ৫০ গুণ বেশি। ২০১৫ সালে সমুদ্র যাত্রীদের বেশিরভাগই ছিল পুরুষ। কিন্তু ২০১৮ সালের সমুদ্রযাত্রীদের শতকরা ৫৯ ভাগই নারী ও শিশু।
ট্রলারে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাঠানো জন্য মানবপাচারকারীরা কক্সবাজারের উপকূলের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ব্যবহার করছে। এগুলো হলো, টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালি, রাজারছড়া, নোয়াখালী পাড়া, হলবনিয়া, জাহাজপুরা ঘাট, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, কাটাবনিয়া, মিঠাপানির ছড়া, জালিয়াপালং, ইনানী, হিমছড়ি, রেজুখাল, কুতুবদিয়াপাড়া, খুরুশকুল, চৌফলদন্ডি ও মহেষখালী। এছাড়া সীতাকুন্ড ও মাঝিরঘাট এলাকা হয়েও ট্রলারে মানবপাচার হয়ে থাকে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয়সহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা। তারা সবাই টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা। এছাড়া মালয়েশিয়া অবস্থানকারী মানবপাচারকারী কয়েকজন রোহিঙ্গার নামও উঠে এসেছে।
টেকনাফের লেদা ডেভেলপমেন্ট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘করোনা ভাইরাস নিয়ে যেখানে গোটা বিশ্ব ভয়ে, সেময় সাগরপথে মানবপাচার বিষয়টি খুবিই দুঃখজনক। তাছাড়া উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া যাওয়ার বা ক্যাম্প থেকে পালানোর প্রবণতা রোহিঙ্গাদের মধ্যে বরাবরই ছিল।
তিনি বলেন, মানবপাচারের জন্য কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প একটা হাব। যেখান থেকে প্রলোভন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া সহজ। ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পাচারকারী ও দালালেরা এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। শিবিরগুলোতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি বৃদ্ধি করা দরকার। কেননা অল্পবয়সী রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করছে। এ বিষয়ে তাদের সচেতন করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের মহাসচিব এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিপুল সংখ্যা রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। সেটি কোনোভাবে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। তবে সাগরপথে মানবপাচার বন্ধ না হলে, দেশে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। তাই পাচার রোধে সবাইকে এক যোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
কক্সবাজারের জেলা অতিরিক্তি পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘মানবপাচারকারীরা টাকায় লোভে সাগরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের। তাছাড়া সচেতনতার অভাবে রোহিঙ্গারা সাগর পাড়ি দিচ্ছে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আর যেসব পাচারকারী এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে, তাদের ধরতে পুলিশের টিম কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের চট্রগ্রাম-পূর্ব জোনের স্টাফ কর্মকর্তা (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (বিএন) এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের অবস্থান পরিষ্কার, নতুন করে কোনও রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা বোঝাই কোনও ট্রলার বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করলে, তা প্রতিহত করা হবে।
কোস্টগার্ড কর্মকর্তা এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘চলতি মাসে কারাগার থেকে ২৫ হাজার বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে মিয়ানমার। তাদের অনেককে ট্রলারে উঠিয়ে আমাদের দিকে ঠেলে দেওয়া সম্ভাবনা রয়েছে। তাই জলসীমায় কোস্ট গার্ড ও নৌবাহনীর টহল জোরদার করা হয়েছে।
পাঠকের মতামত: